gita 2/7
সাংখ্য-যোগ (শ্লোক 7)
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মুঢ়চেতাঃ।
যচ্ছেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ ।। ৭।।
অনুবাদঃ
কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি এক আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর, তা আমাকে বল। এখন আমি তোমার শিষ এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত। দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও।
তাৎপর্যঃ
প্রকৃতির প্রভাবে জড়-জাগতিক কর্মচক্রের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে সকলেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা এই কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা অনুভব করি। তাই আমাদের সত্যদ্রষ্টা সদগুরুর শরণ নিতে হয় এবং তিনি আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন করবার পথে পরিচালিত করেন। আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের জটিল সমস্যাগুলি থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য সদ্গুরুর শরণাপন্ন হবার উপদেশ সমস্ত বৈদিক সাহিত্যে দেওয়া হয়েছে। জড়-জাগতিক ক্লেশ হচ্ছে দাবানলের মতো যা আপনা থেকেই জ্বলে ওঠে, এই আগুন কেউ লাগায় না। ঠিক তেমনই, জগতের এমনই অবস্থা যে, জীবনের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা আপনা থেকেই আবির্ভূত হয়, এই প্রকার বিভ্রান্তি আমরা না চাইলেও। কেউ আগুন চায় না, তবুও আগুন জ্বলতে থাকে এবং তার ফলে আমরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। বৈদিক সাহিত্য তাই উপদেশ দিচ্ছে যে, জীবনের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা সমাধানের জন্য এবং সেই সমাধানের বিজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করবার জন্য গুরু-পরম্পরার ধারায় ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন যে সদ্গুরু, তাঁর শরণাপন্ন হতে হবে। যে ব্যক্তি সদ্গুরু তিনি সর্ব বিষয়ে পারদর্শী। তাই, জড় জগতের মোহের দ্বারা আবদ্ধ না থেকে সদগুরুর শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এটিই হচ্ছে এই শ্লোকের তাৎপর্য।
জড় জগতের মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন কে? যে মানুষ তার সমস্যাগুলি সম্বন্ধে অবগত নয়, সেই হচ্ছে মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন। বৃহদারণ্যক্ উপনিষদে (৩/৮/১০) মোহাচ্ছন্ন মানুষের বর্ণনা করে বলা হয়েছে- যো বা এতদক্ষরং গার্গ্যবিদিত্বাস্মাল্ লোকাৎ প্রৈতি স কৃপণঃ। "যে মানুষ তার মনুষ্য জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে না এবং আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি না করে কুকুর-বেড়ালের মতো এই জগৎ থেকে বিদায় নেয়, সেই হচ্ছে কৃপণ।" এই মানবজন্ম হচ্ছে একটি অমূল্য সম্পদ, কারণ, জীব এই জন্মের সদ্ব্যবহার করে জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে; তাই, যে এই অমূল্য সম্পদের সদ্ব্যবহার করে না, সে হচ্ছে কৃপণ। পক্ষান্তরে, যিনি যথার্থ বুদ্ধিমত্তা সহকারে মানব-জন্মের সদ্ব্যবহার করে জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করেন, তিনি হচ্ছেন ব্রাহ্মণ। য এতদক্ষরং গার্গি বিদিত্বাম্মাল্ লোকাৎ প্রৈতি স ব্রাহ্মণঃ।
যে কৃপণ সে পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি আদি জড় সম্বন্ধের প্রতি অত্যধিক আসক্ত হয়ে তার সময়ের অপচয় করে। মানুষ প্রায়ই এক ধরনের 'চর্মরোগের' দ্বারা আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন সমন্বিত পরিবারের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়ে। এই রোগকে 'চর্মরোগ' বলা হয়, কারণ দেহের ভিত্তিতে বা চর্মের ভিত্তিতে এই আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে ওঠে এবং এই বন্ধনের ফলে জীব অত্যন্ত ক্লেশদায়ক ভবযন্ত্রণা ভোগ করে। কৃপণ মনে করে, সে তার পরিবারের তথাকথিত আত্মীয়দের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে; নয়ত সে মনে করে, তার আত্মীয়স্বজন তাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এই ধরনের পারিবারিক বন্ধন এমন কি পশুদের মধ্যেও দেখা যায়, তারাও তাদের সন্তানদের যত্ন করে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা-সম্পন্ন অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন, আত্মীয়-পরিজনদের প্রতি তাঁর মমতা এবং তাদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার বাসনাই ছিল তাঁর মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কারণ। যদিও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর যুদ্ধ করার কর্তব্য তাঁকে সম্পাদন করতে হবে, কিন্তু তবুও কৃপণতা জনিত দুর্বলতার ফলে তিনি তাঁর সেই কর্তব্য সম্পাদন করতে পারছিলেন না। তাই তিনি পরম গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুনয় করছেন, তাঁর এই সমস্যার সমাধান করার উপায় প্রদর্শন করতে। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তাঁর শিষ্যরূপে আত্মসমর্পণ করেন। শ্রীকৃষ্ণকে তিনি আর বন্ধুরূপে সম্ভাষণ। করছেন না। গুরু ও শিষ্যের মধ্যে যে কথা হয়, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন অর্জুন তাই গভীর গুরুত্বের সঙ্গে পরম গুরু শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পরম তত্ত্বদর্শনের আলোচনা করতে চান। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবদ্গীতার তত্ত্ববিজ্ঞানের আদি গুরু এবং অর্জুন হচ্ছেন গীতার তত্ত্ব-উপলব্ধিকারী প্রথম শিষ্য। অর্জুন কিভাবে ভগবদ্গীতার জ্ঞান উপলব্ধি করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা ভগবদ্গীতাতেই করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গর্দভসদৃশ জড় পণ্ডিতেরা গীতার ব্যাখ্যা করে বলে, শ্রীকৃষ্ণ নামক কোন পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করার কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের অন্তঃস্থিত অপ্রকাশিত যে-তত্ত্ব, তাকে উপলব্ধি করাই হচ্ছে গীতার প্রকৃত শিক্ষা। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অনাদির আদিপুরুষ স্বয়ং ভগবান। তাঁর অন্তর আর বাইরের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, তিনি সর্বব্যাপ্ত, সর্বশক্তিমান। কিন্তু এই জ্ঞান যার নেই, সেই মহামূর্খের পক্ষে গীতার মর্ম উপলব্ধি করা কখনই সম্ভব নয়।